মেয়েটি মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান।ছোটবেলা থেকে বাবা মাকে কষ্টের সাথে বসবাস করতে দেখেছে। দেখেছে দূর্বলের প্রতি সমাজের অনাচার। শত আঘাত সহেও ভেঙ্গে না পড়ে, সবরের শিক্ষা মা বাবার কাছে পেয়েছে। আর তাই কোন কষ্টকে আজকাল কষ্ট মনে হয়না। মনে হয় কষ্টকে জয় করার মধ্যেই জীবন চালিয়ে নিতে হবে। পরাজয় মানলে হবেনা। না হলে অপরাজিতা নাম কেন হবে?
বিয়ের পর শুরু হলো অপরাজিতার আরেক সংগ্রামী জীবন। বাসর রাতে হাজব্যান্ড তমাল জানিয়ে দিলো, ঘরের সবার মন জুগিয়ে চলতে হবে।তুমি ছোট বউ তোমার দায়িত্ব বেশি। বড় ভাবী এতদিন সংসার সামলিয়েছেন, এখন তার রেস্ট নেয়া দরকার। অপরাজিতা প্রথম রাতেই বুঝে নিলো তার স্বামী হাজব্যান্ড হিসেবে কত পারফেক্ট।
শাশুড়ী ননদ ঝা সবাই অপরাজিতার কাছে বলতো, তমাল খুব গরম। ঘরের সবাই তাকে ভয় পায়। তার কথামতো না চললে, সংসারে অশান্তি। ঘরের কাম কাজ ঠিকমতো করা চাই। তমাল পরিপাটি থাকা পছন্দ করে। সবকিছু সময়মতো হওয়া চাই।রান্নাবান্না ওর পছন্দ মাফিক হওয়া চাই।
নতুন পরিবেশে এসে একটা মেয়েকে খাপ খাওয়াতে সময় লাগে। কোথায় সবাই তাকে সাহস দিবে, ভালোবেসে আপন করে নিবে- তা না, উল্টো স্বামীর প্রতি ভয় ঢুকিয়ে দূরে ঠেলে দিচ্ছে।
তমাল বউয়ের সাথে গল্প গুজব করার সময় পায় না সত্য। কিন্তু ঘরের সবার সাথে বসে আড্ডা দেয়। বউ তো বউ, শুধু বিছানার সঙ্গী। তার সাথে কি আর কথা থাকতে পারে! ঘরের সবাই যেন তমালকে বউয়ের কাছ থেকে সরিয়ে রাখতে পারলেই
মনোবাঞ্ছা পূরণ হয়।
অথচ বিয়ের ক’দিনই বা হলো, অপরাজিতার ইচ্ছে করে মনমানুষের কাছে বসে একটু গল্প করতে। ক’দিনের জন্য কোথাও ঘুরে আসতে। সারাদিন হেশেলে রান্না, সবার মন জুগিয়ে চলা এটাই কি তার দায়িত্ব? নিজের আপন বলতে কি কিছু নেই? বিয়ের পর থেকে বাবার বাড়ি আত্মীয় বন্ধু কারো সাথেই যোগাযোগ নেই। চার দেয়ালের শশুর গৃহ তার কাছে খাঁচার মতো মনে হয়।
রাতে বিছানায় শুয়ে শুয়ে অশ্রু জলে বালিশ সিক্ত হয়েছে বেশ ক’দিন। এবার আর নয়। মেরুদন্ড সোজা করার সময় হয়েছে। মনে মনে শপথ করে অপারাজিতা।তাকে হার মানলে হবেনা। বদ্ধ খাঁচা থেকে তাকে বের হতে হবে। গোপনে গোপনে চাকুরির জন্য নানান জায়গায় এপ্লাই করে।
একসময় একটা প্রাইভেট কলেজে জবের অফার পায় অপরাজিতা। বউ চাকুরি করবে কথাটা শুনে পরিবারের সবার চোখ কপালে উঠলো। তমাল তো রেগে আগুন। কত বড় সাহস তোমার, তুমি চাকুরি করবে? তোমার কিসের অভাব?
এইবার অপরাজিতা মুখ খুললো, আমার কোন কিছুর অভাব নেই। আমি মুক্ত পৃথিবী দেখতে চাই। প্রাণ ভরে শ্বাস ফেলতে চাই। পরাধীনতার শৃঙ্খল থেকে মুক্তি চাই। প্লিজ আমাকে কয়েকটা দিন আমার মতো থাকতে দাও। তমালের এক কথা চাকুরি করলে,এ বাড়ির দরজা তোমার জন্য বন্ধ।
পরদিন ভোরে উঠে এক কাপড়ে বেড়িয়ে পড়লো অপরাজিতা। তাকে নিজের পায়ে দাঁড়াতে হবে।আপাতত বান্ধবীর বাসায় উঠবে। কাজে জয়েন করে, পরে এক রুমের একটা বাসা ভাড়া করবে।অনেকদিন পর মুক্ত হাওয়ায় প্রাণ ভরে শ্বাস নিলো অপরাজিতা। খোলা চুলগুলো বাতাসে দুলছে।শাড়ির আঁচলে চোখ মুছলো অপরাজিতা। তারপর ট্রেন ষ্টেশনের উদ্দেশ্যে রিকশায় উঠলো।