জুথি ভাবীর সাথে আমার পরিচয় হাসপাতালে। কয়েকদিন ধরে ব্লাড প্রেসার খুব বেড়েছে, সাথে ডাইবেটিস তো আছেই! প্রাইভেট ডাক্তারে না গিয়ে, হাসব্যান্ডের কথায় চলে গেলাম হসপিটাল ইমার্জেন্সিতে।উনার ধারণা একসাথে টেস্ট করিয়ে যদি তাড়াতাড়ি সুস্হ্য হওয়া যায়। হসপিটাল ইমার্জেন্সিতে যেতে আমার মন চায় না। দীর্ঘক্ষণ বসে থাকতে হয়। তারপর হাজব্যান্ডের পীড়াপীড়িতে যেতে হলো। বাচ্চাদের স্কুলে দিয়ে সকাল, সকাল চলে গেলাম দু’জন। ওয়েইটিং রোমে বসে দেখলাম,পাশের সিটে একজন মহিলা ২০/২১ বছরের একটি অসুস্হ্য মেয়েকে নিয়ে বসে আছেন। ভদ্রমহিলার চোখ দু’টো ফোলা, ফোলা। মনে হয় খুব কেঁদেছেন।পোশাক-আশাকে বাঙালী মনে হওয়ায় কাছে গিয়ে একটু কথা বললাম।
ভদ্রমহিলার নাম জুথি। লন্ডন এসেছেন প্রায় বিশ বছর।দুই মেয়ে। বড় মেয়ে ইউভার্সিটিতে পড়ে, ছোট মেয়ে কলেজে। বড় মেয়ের কয়েক মাস আগে থাইরয়েড ক্যন্সার ধরা পড়লে, অপারেশন করিয়েছেন। কিন্তু প্রায়ই গলায় ব্যথা। কথা বলতে খুব কষ্ট হয়। প্রায়ই ডাক্তারে এসে চেকআপ করাতে হয়। ভদ্রমহিলা কথা বলতে, বলতে কেঁদে ফেলছেন। মনে হচ্ছে মেয়ের চেয়ে তিনি আরও বেশি অসুস্হ্য। শান্তনা দিয়ে বললাম,আপনি একা এসেছেন মেয়েকে নিয়ে? ওর বাবা কোথায়? মনে হলো কিছু আড়াল করতে চাচ্ছেন, হয়তো বা লজ্জা পাচ্ছেন।আমি আর কথা বাড়ালাম না। আমার হাজব্যান্ডের সহায়তায় ডাক্তার দেখানোর পর টেক্সি ডেকে উনাদের বাসায় পাঠিয়ে দিলাম। কথা প্রসঙ্গে ভদ্রমহিলার ফোন নম্বর সংগ্রহ করেছিলাম।
কেন জানি অল্প সময়ে মহিলার সাথে আমার একটা সম্পর্ক তৈরী হলো। মেয়েটির অসুখের জন্য খুব মায়া হলো। এরপর মাঝে মধ্যে ফোন করে আমি মেয়েটির খবর নিতাম। সেই থেকে উনার সাথে আমার একটা আন্তরিক সম্পর্ক গড়ে উঠলো। এই বিদেশে অনেকের আপন কেউ নেই। কারো সাথে অল্প পরিচয়েও গড়ে উঠে মধুর সম্পর্ক। জুথি ভাবীর সাথেও তেমনি। মাঝে মধ্যে অফিস ছুটির দিন আমি উনার বাসায় যেতাম। ভদ্রমহিলা খুবই অতিথি পরায়ণ। গেলেই হাতের তৈরী এটা সেটা না খাইয়ে ছাড়তেন না। মাঝে মধ্যে আমিও রান্না করে নিয়ে যেতাম। তারপর উনার কাছ থেকে জেনে নিলাম উনার জীবনের অন্য গল্প।
স্বামীর সাথে সেপারেশন হয়েছে ১৫ বছর। লন্ডন আসার কয়েক মাসের মধ্যে টের পান তার স্বামী পরনারীতে আসক্ত। বউ বাচ্চার দিকে তার নজর নেই। সামান্য কারণে স্ত্রীকে গালাগালি এমনকি গায়ে হাত তুলতো। এই নিয়ে প্রায় সময়ই বাসায় ঝগড়া হতো। বাচ্চারা তখন ছোট। মায়ের প্রতি বাবার এই অনাচার ওদের ছোট মনে কষ্ট দিতো কিন্তু ভয়ে বাবাকে কিছু বলতো না। একদিন ঝগড়ার মুহূর্তে এক প্রতিবেশী, পুলিশকে ফোন করে দেয়।তারপর পুলিশ এসে স্বামীকে ধরে নিয়ে যায়। পুলিশ বাচ্চাদের জবানবন্দি নেয়। বাচ্চারা পুলিশকে বাবার সব অন্যায় বলে দেয়। সেইথেকে আইনি সহায়তায় জুথি মেয়েদের নিয়ে একাকী জীবন কাটাচ্ছেন।
প্রথম কয়েক বছর জুথি কেয়ারারের জব করেছেন।তারপর মেয়ে বড় হওয়ায়,পড়াশুনার পাশাপাশি বড় মেয়ে একটা সুপার মার্কেটে কাজ করে। আর সরকারী সাহায্যে চলে যায় সংসার। খুব বেশি চাহিদা নেই জুথির। এখন মেয়েটির অসুখ নিয়ে, ভেঙে পড়েছেন। একাকী সংগ্রাম করে যাচ্ছেন। দেশে থাকলে হয়তো, আজ তার পাশে আপনজন কেউ থাকতো। প্রবাসের জীবন আজ তার কাছে বড়ই নিঃসঙ্গ মনে হচ্ছে।
শাহারা খান
কবি, লেখিকা
লন্ডন প্রবাসী (বাড়ি সিলেট)